হযরত মা ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 7

হযরত মা ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 7

খায়বরের যুদ্ধে হযরত আলী (রাঃ)-এর বীরত্ব

সপ্তম হিজরীতে হুযুর (সাঃ) খায়বার অভিযানে সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করলেন। খায়বারে সর্ব মোট দুর্গের সংখ্যা তিন শতাধিক। এর মধ্যে গুটি কয়েক দুর্গ ছিল অতি সুদৃঢ় ও দুর্ভেদ্য। মদীনা থেকে কুচক্রী ইহুদী জাতি বিতাড়িত হয়ে খায়বারে এসে জড়ো হয়েছিল । 

এখানে এসে তারা মদীনা আক্রমণ করার চক্রান্ত করতেছিল। হুযুর (সাঃ) এ সংবাদ পেয়ে হোদাইবিয়া থেকে ফিরে আসা ১৪০০ শত সাহাবীদের নিয়ে খায়বার অভিমুখে যাত্রা করলেন । মূল সৈন্য বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করলেন হযরত সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস (রাঃ)কে। 

এছাড়া মুসলিম বাহিনীর বিভিন্ন দিকের যুদ্ধ পরিচালনার ভার বিভিন্ন খ্যাতনামা সাহাবীদের উপর ন্যাস্ত করলেন ।
যথাযথ প্রস্তুতি শেষ করে হুযুর (সাঃ) খায়বার অভিমুখে যাত্রা করেন। এর পর দিন ভোরে খায়বার নামক স্থানে গিয়ে পৌঁছেন, কুচক্রী ইহুদী জাতি দুর্গের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে নেয়। 

যার ফলে মুসলমানদের জন্য দুর্গ অবরোধ না করে কোন উপায় ছিল না। এ যুদ্ধে ইহুদীদের সংখ্যা দশ হাজারের ও অনেক বেশি ছিল । প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত যুদ্ধ চলল। কিন্তু জয় পরাজয় কিছুই স্থির হলো না । এভাবে দীর্ঘ দিন অবরোধ চলার পর অবশেষে এক দিন ফজরের নামাযের পর হুযুর (সাঃ) বললেন, আজ আমি এমন এক ব্যক্তর হাতে যুদ্ধের পতাকা দান করব। 

তার নেতৃত্বে আল্লাহর রহমতে খায়বারবাসীদের পতন হবে।
হুযুর (সাঃ)-এ উক্তি শুনে সাহাবীদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেলে, সকলে মনে মনে ভাবতে লাগলেন, কে এই সৌভাগ্যবান, যার হাতে খায়বারবাসীদের পতন নিশ্চিত। সমবেত সাহাবীদের প্রত্যেকে একে অপরের প্রতি তাকাতে লাগলেন, তবে তাঁরা মুখে কোন কিছু উচ্চারণ করতে পারছেন না ।

যার হাতে খায়বারবাসীদের পতন হবে তিনি কিন্তু এ কয় দিন যুদ্ধে ক্ষেত্রে যোগদান করতে পারেননি। তিনি চোখের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। এ কারণে তিনি উপস্থিত সাহাবীদের সাথে সমবেত ও ছিলেন না। তবে তিনি মুজাহিদ বাহিনীর সাথে খায়বারে আগমন করেছেন। সাহাবীদের সকলে চাতক পাখির ন্যায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কার নাম উচ্চারণ করে বসেন, আর কে হবে সেই সৌভাগ্যবান পুরুষ ৷

অল্পক্ষণ পরেই সকল আশা নিরাশার যবনিকা পাত হলো, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, আলী কোথায়? তাঁকে ডেকে নিয়ে আস!
হযরত আলী (রাঃ) নাম শুনে সাহাবীগণ মনে মনে ভাবলেন। আলী (রাঃ) তো চোখের পীড়ায় অস্থির হয়ে আছেন। 

তথাপিও সাহাবীদের মধ্যে থেকে একজন গিয়ে হযরত আলী (রাঃ)কে হুযুর (সাঃ) সামনে নিয়ে আসলেন, হুযুর (সাঃ) নিজ পবিত্র মুখ থেকে কিছু লালা নিয়ে হযরত আলী (রাঃ) চোখে লাগিয়ে দিলেন এবং বললেন । হে আলী! যুদ্ধের পতাকা হাতে নাও এবং ইহুদীদের দুর্গ আক্রমণ কর।

হুযুর (সাঃ)-এর পবিত্র মুখের লালা হযরত আলী (রাঃ) চোখে লাগানো মাত্রই তাঁর চক্ষু পূর্বের ন্যায় সুস্থ হয়ে গেল। মহাবীর আলী (রাঃ) হুযুর (সাঃ) থেকে অনুমতি নিয়ে বীরবিক্রমে ইহুদীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, মুহূর্তের মধ্যে শুরু হলো যুলফিকারের বিজলীর ন্যায় চমক । 

আর সংগে সংগে ছিন্ন হয়ে পড়ল ইহুদী বাহিনীর বীর যোদ্ধা মারহাবের মস্তক ।
মারহাবের শোচনীয় অবস্থা দেখে ইহুদীবাহিনী ভীত হয়ে দুর্গে আশ্রয় নিল এবং ভিতর থেকে দুর্গের কপাটসমূহ বন্ধ করে দিল। ইহুদীদের ধারণা সুদৃঢ় কপাট গুলি ভেদ করে মুসলিম বাহিনীর পক্ষে ভিতরে প্রবেশ করা সম্ভব হবে না । 

তাই তারা কিছু দিন দুর্গ অবরোধ করে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে অবরোধ তুলে নিয়ে ফিরে চলে যাবে ।
কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) মুসলিম বাহিনীকে বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন, এবং বললেন বিরাট বিরাট প্রস্তর খণ্ড এনে সজোরে দুর্গ কপাটের উপর প্রচন্ড বেগে নিক্ষেপ করতে থাক ।

এভাবে প্রচণ্ড বেগে যুদ্ধ পরিচালনাকারী বীর কেশরী হযরত আলী (রাঃ) হায়দারী হাত দিয়ে দুর্গকপাটে ধাক্কা দিলেন। ধাক্কার বেগে কপাট ভিতরের দিকে সামান্য ঢুকে পড়ল। হযরত আলী (রাঃ) বুঝতে পারলেন যে, প্রচণ্ড বেগে আঘাত হানলে দুর্গ কপাট উপড়ে যাবে, তিনি তাই করলেন, মুহূর্তের মধ্যে আল্লাহর সিংহ দুর্গ কপাট উপড়ে ফেললেন। 

আর মুসলিম বাহিনী ঝড়ের বেগের ন্যায় দুর্গে ঢুকতে লাগলেন। ইহুদী বাহিনী ও শোচনীয় পরাজয়ের হাত কে বাঁচার জন্য প্রাণপণে যুদ্ধ করতে লাগল। উভয় পক্ষেই তুমুল যুদ্ধ চলতে লাগল। যুদ্ধের তীব্রতার মুখেই মহাবীর আলী (রাঃ)-এর পরপর কয়েক খানা ঢালই ভেংগে যায়। 

এক পর্যায় তিনি উপড়ানো দুর্গ কপাটটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন। যুদ্ধ শেষে তিনি ঢাল যুদ্ধ ক্ষেত্রে ফেলে আসেন অবশেষে কুচক্রী ইহুদী জাতি উপায় অন্তর না দেখে মুসলমানদের নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, হযরত আলী (রাঃ) যুদ্ধের সময় যে দুর্গ কপাটটি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যুদ্ধ করছিলেন। 

যুদ্ধের পর কতিপয় বিশিষ্ট সাহাবী ও সমবেত ভাবে চেষ্টা করে উক্ত ঢালটিকে মাটি থেকে শূন্যে তুলতে সক্ষম হননি। আলোচ্য এ ঘটনার দ্বারা এ কথা সহজে বুঝা যায় যে, হযরত আলী (রাঃ) কি পরিমাণ দৈহিক শক্তির অধিকারী ছিলেন ।

মক্কা বিজয়ে হযরত আলী (রাঃ)-এর ভূমিকা

হোদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি ভংগ করার কারণে অষ্টম হিজরী সনে হুযুর (সাঃ) দশ হাজার মুসলিম সৈন্যের একটি বিরাট বাহিনী নিয়ে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করলেন। এবং বলতে গেলে প্রায় বিনা বাধায় তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন।

এই সে প্রিয় জন্মভূমি মক্কা, যে মক্কানগরী থেকে এক দিন রাসূল (সাঃ) রাতের আঁধারে পলায়ন করতে হয়েছিল, এই সে মক্কা যে মক্কাবাসীগণ এক দিন ইসলাম ও মুসলমানদেরকে চির দিনের জন্য ধরা পৃষ্ঠ থেকে নির্মূল করার জন্য একতাবদ্ধ হয়েছিল। 

এই সে মক্কাবাসীগণ যাদের ভয়ে মুসলমানদেরকে এক দিন মদীনাতে রিক্ত হস্তে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
কিন্তু আজ সত্য সমাগত মিথ্যা পরাজিত। আজ পলায়নকারী মুসলমানগণ বিজয়ীর বেশে দলে দলে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করছেন। মুসলমানদেরকে দলে দলে মক্কাতে প্রবেশ করতে দেখে মক্কাবাসীরা মনে মনে প্রমোদগুনল । 

মুসলমানদের প্রতি এতো দিন তারা যে অন্যায় আচরণ করেছে তারা কঠোর প্রতিশোধ গ্রহণ না করে ছাড়বেন না। কিন্তু ক্ষণকালের মধ্যে তাদের সে ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছিল।

কেননা বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী করুণার আঁধার রাহমাতুললিল আলামীন মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্য করে ঘোষণা দিলেন, হে মক্কাবাসীগণ! আজ
তোমরা আমার নিকট থেকে কিরূপ ব্যবহার পেতে চাও। মক্কাবাসীরা আতংকিতাবস্থায় জবাব দিল – আপনি নিজেও বিনয়ী এবং বিনয়ী পিতার সন্তান।

বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত হুযুর (সাঃ) তখন মক্কাবাসীদেরকে লক্ষ্য করে ঘোষণা করলেন “আজ তোমাদের উপর কোন প্রতিশোধ নাই। যাও তোমরা সবাই মুক্ত স্বাধীন। দয়ার সাগর মহানবী (সাঃ) অকাতরে হাতে গুণা কয়েক জন ব্যতিত মক্কাবাসী সকলকে ক্ষমা করে দিলেন। 

মহানবী (সাঃ)-এর এরূপ অভাবিত উদার ব্যবহার দেখে মক্কাবাসীগণ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে পড়ল । এ সময় কিন্তু পবিত্র কাবাগৃহে ৩৬০টি প্রতিমা রক্ষিত ছিল। আর পবিত্র কাবা গৃহের দেয়ালে মানব জাতির আদি পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও তদ্বীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর ছবি ঝুলানো ছিল। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধ্রুনের জুয়া খেলার ছবি ঝুলানো ছিল। 

এমনকি উলঙ্গ নর-নারীর ছবি ঝুলানো ছিল হুযুর (সাঃ) পবিত্র কাবাগৃহে প্রবেশ করতঃ হাতের লাঠি দিয়ে প্রতিমাগুলোর প্রতি ইশারা করা মাত্রই প্রতিমাগুলো ভেংগে খান খান হয়ে পড়তে লাগল, এভাবে একের পর এক ৩৬০টি প্রতিমার সব কয়টি প্রতিমাকে ধ্বংস করে দেয়া হল।
অতঃপর হুযুর (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ)কে পবিত্র কাবা গৃহের দেয়ালের ছবিগুলো মুছে ফেলার নির্দেশ দেন।

তিনি যথাযথ ভাবে নির্দেশ পালন করে ছবিগুলো মুছে ফেললেন । কিন্তু একটি ছবি অনেক উপরে ঝুলন্ত থাকায় তা নিচে নামানো সম্ভব হয়নি। তাই হুযুর (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে তাঁর কাঁধে চড়ার নির্দেশ দেন হযরত আলী (রাঃ) হুযুর (রাঃ) কাঁধে আরোহণ করত। সে ঝুলন্ত ছবিটি ও নিচে নামিয়ে ফেললেন। এভাবে তারা উভয় মক্কার ঘরকে প্রতিমামুক্ত করে পবিত্র করে তুললেন।