হযরত মা ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 5

হযরত মা ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 5

হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর স্বামীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়

মুসলিম বিশ্বের চতুর্থ খলিফা এবং কিশোরদের মধ্যে সর্ব প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পিতৃব্য, প্রতি পালক ও আশ্রয় দাতা মহাপ্রাণ আবদুল মুত্তালিবের পুত্র। 

বংশ পরস্পরায় আবদুল মুত্তালিব ছিলেন কোরেশ দলপতি ও পবিত্র কাবা গৃহের রক্ষণাবেক্ষণকারী। সত্য নিষ্ঠা, ধর্ম পরায়ণতা ও সাহসিকতায় তিনি ছিলেন জেহালতের অন্ধকারে নিমজ্জিত আরব সমাজে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভক্তির অধিকারী। 

যার প্রভাবে নবুয়্যতের প্রথম যুগের সব বিপদাপদ ও শত্রুতার মুখে মুহাম্মদ (সাঃ) নিরাপদে ছিলেন।
অর্থনৈতিক দিক হতে আবদুল মুত্তালিব অসচ্ছল ছিলেন বলে হযরত আলী (রাঃ) শৈশব কাল হতেই বিশ্ব নবী (সাঃ)-এর আশ্রয়ে ও তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হতে ছিলেন। ফলতঃ বিশ্বনবী (সাঃ)-এর সৎসঙ্গে পূর্ণ সময় অতিবাহিত করার দরুন তাঁর দুর্লভ স্বভাব চরিত্রের আলোকে আলোকিত হয়ে হযরত আলী সর্বদিক হতে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের অধিকারী রূপে গড়ে উঠেছিলেন ।

শিশুকাল হতেই হযরত আলী ছিলেন দুর্জয় সাহসী ও অসাধারণ দৈহিক শক্তির অধিকারী। যার পরিচয় পরবর্তীকালে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কারণে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রণাঙ্গনে তৎকালীন পৃথিবীর বীরযোদ্ধারা পেয়ে বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছিলেন এবং যে শৌর্য-বীর্য তাঁকে বিশ্বের অবিস্মরণীয় বীরদের নামের তালিকার শীর্ষে স্থান দান করেছিল। 

পৃথিবীর ইতিহাস আসাদুল্লাহ বা আল্লাহর সিংহ নামে তাঁকে আখ্যায়িত করে তাঁর সে দুঃসাহসী ও দুর্জয় শক্তির পরিচয়কে আবহমান কাল ধরে অনন্ত কালের মানুষের জন্য বহন করে চলেছে।

হযরত আলী (রাঃ) শিশু কাল হতেই ছিলেন ধীর স্থির, শান্ত শিষ্ট সংযমী ও নিরীহ প্রকৃতির। তাঁর ধী-শক্তি, মেধা ও জ্ঞানানুরাগ হুযুর (সাঃ)-কে তাঁর প্রতি এমন আকৃষ্ট করে ফেলেছিল যে, হুযুর (সাঃ) নিজ পবিত্র জবানেই আলী (রাঃ)-এর জ্ঞানের গভীরতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমি জ্ঞানের নগরী আর আলী উহাতে প্রবেশ দ্বার সদৃশ।"

হুযুর (সাঃ)-এর সহিত হযরত আলী (রাঃ)-এর ভালবাসা এত নিবিড় ও অকৃত্রিম ছিল যে, হুযুর (সাঃ) সে ভালবাসার রূপ বর্ণনা করতে, গিয়ে প্রায়সঃই বলতেন, "আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে।”
কুরাইশগণ সর্বশ্রেষ্ঠ বংশ হিসেবে আরবের যাবতীয় গোত্রসমূহের নিকট ছিল বিশেষ সম্মানের অধিকারী। জ্ঞান-গরিমা ও প্রতিপত্তিতে সারা আরব ভূখণ্ডে কুরাইশগণ ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও তুলনাহীন। 

কাবাগৃহের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও তদীয় পুত্র ইসমাইল (আঃ)-এর বংশধর বলে পবিত্র কাবা গৃহের রক্ষণাবেক্ষণের ভার এ কোরেশ বংশের উপরই ন্যস্তছিল। যুগ যুগ ধরে এ গোত্রের গোত্রপতিগণই পবিত্র কাবা গৃহের সেবায়েতের দায়িত্ব ভার পালন
করতেন।

এ কোরেশ গোত্রের একজন গোত্র প্রধানের নাম ছিল মৃগীরা। যিনি ধার্মিক ও সদাচারী হিসেবে সারা আরব জুড়িয়া বিশেষ খ্যাতি ও সম্মানের অধিকারী ছিলেন? সাহস, বুদ্ধি ও গোত্র পরিচালনার নৈপূণ্যে যার কোন জুড়ি ছিল না। 

দীর্ঘ দিন যোগ্যতার সহিত নেতৃত্বদান ও কাবাগৃহের সেবায়েতের দায়িত্ব পালনের পর তিনি পরলোক গমন করেন ।
মৃত্যু কালে মুগীরা ছয় পুত্র ও ছয় কন্যা রেখে যান। এ পুত্র ও কন্যাগণের মধ্যে মেধা, বুদ্ধি, জ্ঞান ও সাহসিকতায় হাসেম ছিলেন সর্বজনবরেণ্য। তাই পিতার লোকান্তরের পর হাসেমই পিতার স্থলাভিষিক্ত হন ।

হাসেমের প্রকৃত নাম ছিল ওমর আর তাঁর উপাধি ছিল আমরু আলা । কিন্তু বিশেষ কারণে কালে তিনি হাসেম নামে প্রখ্যাত হয়ে উঠেন।
হাসেম ছিলেন অত্যধিক অতিথিপরায়ণ। হজ্জ মৌসুমে হজ্জব্রত পালনার্থে ও কাবাগৃহের দর্শনাভিলাষে আগত লোকদেরকে তিনি খানা খাওয়াইতেন। 

তিনি বড় বড় রুটি তৈরি করে উক্ত রুটিসমূহকে টুকরা টুকরা করে তরকারীসহ মেহমানদের মধ্যে বিতরণ করতেন। 
আরবীতে হাশসুন শব্দের অর্থ টুকরা বা খণ্ড করা। আর যে ব্যক্তি কোন কিছুকে টুকরা বা খন্ড করে তাকে হাসেম বলে। সুতরাং এ কারণেই তিনি হাসেম নামে সর্বত্র পরিচিতি লাভ করেন।

নিজ লোকদের ভাগ্য উন্নয়নের চেষ্টায় হাসেম ছিলেন অত্যধিক তৎপর। তৎকালীন আরবদের একমাত্র রোজগারের পথ ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। তাই হাসেম নিজ গোত্রের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিলেন। 

এতদউদ্দেশ্যে তিনি রোম সম্রাটের দরবারেও গেলেন। সেখানে তিনি নিজ এলাকার আর্থিক অবস্থা ও লোকজনদের বাণিজ্যিক প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করে শুল্ক মওকুফের জন্য প্রার্থনা জানান। বাদশা হাসেমের আচরণ, বুদ্ধি মত্তা ও বংশ পরিচয়ে মুগ্ধ হয়ে রোম সম্রাট কোরেশদের জন্য রোমে বাণিজ্য শুল্ক মওকুফ করে দেন।

রোম সম্রাটের সহিত হাসেমের এ চুক্তি কোরেশদের জন্য যেমনি আর্থিক সহযোগীতার সৃষ্টি করল ঠিক তেমনি রোমসম্রাটের এই বদান্যতা তাদেরকে অবর্ণনীয় সম্মানে ও ভূষিত করল ।

কোরেশ বংশে ও অনেক শাখা প্রশাখা রয়েছে—তন্মধ্যে এ হাসেম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই হাসেমী গোত্র বনু হাসেম ই সর্বদিক হতে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার।
হাসেমের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র আবদুল মুত্তালিব নিজ সততা, ধর্মনিষ্ঠা ও যোগ্যতা বলে কোরেশকুলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা মনোনীত হন । এই আবদুল মুত্তালিবই ছিলেন হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ)এর পিতামহ ।

আবদুল মুত্তালিব নিজ পূর্ব পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি কৃতিত্ব ও ব্যক্তিত্বের দাবীদার ছিলেন। তিনি ছিলেন একত্ববাদে বিশ্বাসী ও একনিষ্ঠ ব্যক্তি । এই প্রতিশ্রুতিতে তার জীবনে সংঘঠিত বিভিন্ন ঘটনাই ইহার প্রমাণ বহন করে
চলেছে। এই আব্দুল মুত্তালিবের আমলেই ইয়ামানের বাদশা আব্রাহা হস্তি বাহিনী লইয়া মক্কার পবিত্র কাবা গৃহকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করেন। 

ক্ষুদ্র একটি সম্প্রদায়ের অধিপতি মুত্তালিব আব্রাহার এ বিরাট বাহিনীর মোকাবেলায় তৃণ তূল্য বিধায় আব্রাহার আক্রমণ পথে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা তিনি ত্যাগ করলেন এবং দৃঢ় প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের সাথে পবিত্র কাবাকে রক্ষার দায়িত্ব কাবার মালিক আল্লাহর উপর ন্যাস্ত করে নিজ দলবল সহ মক্কার পার্শ্ববর্তী পর্বতে আশ্রয় নিলেন ঋষি পুরুষ আবদুল মুত্তালিব। 

ইহার সামান্য পরেই আব্রাহা কাবাগৃহ আক্রমণ করলে আল্লাহর অশেষ লীলায় আকাশ পথে আবাবীল নামক এক ঝাঁক পাখি আব্রাহা বাহিনীকে আক্রমণ করে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। পৃথিবীর ইতিহাসের এই অলৌকিক ঘটনাই কোরেশ দলপতি ও পবিত্র কাবার সেবায়েত আবদুল মুত্তালিবের ধর্ম পরায়ণতার নজীর বহন করে ।

নবী গৃহে হযরত আলী (রাঃ)-এর আগমন

হুযুর (সাঃ) বাল্যকালেই পিতামাতা হারিয়ে দাদা আবদুল মোত্তালিবের তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হতে থাকেন। কিন্তু এ সুখ তাঁর কপালে বেশি দিন সইল না। অল্পদিনের মধ্যে তিনি দাদা আবদুল মোত্তালিবকে হারান । দাদাকে হারানোর পর হুযুর (সাঃ) একেবারে অসহায় হয়ে পড়েন।

দাদার মৃত্যুর পর চাচা আবু তালেব হুযুর (সাঃ)-এর লালন পালনের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। পুরা যৌবনই হুযুর (সাঃ) চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে লালিতপালিত হন। যার কারণে একান্ত আপন মনে সাধনা করতে সক্ষম হয়েছেন। 

কুরাইশদের যাবতীয় অন্যায় অত্যাচারকে চাচা আবু তালিব দৃঢ়তার সাথে প্রতিরোধ করেছেন। মোট কথা এ সময় চাচা আবু তালিব ছিলেন তাঁর প্রধান সহায় । নচেৎ হুযুর (সাঃ)কে আরো বেশি পরিমাণে বিপদের সম্মুখীন হতে হত। চাচা আবু তালিবের উপকারের কথা হুযুর (সাঃ) এক মুহূর্তের জন্য ও ভুলেননি। বরং তিনি সর্বদা চাচার প্রতিদান পরিশোধের চেষ্টায় ছিলেন।

চাচা আবু তালিবের আর্থিক অবস্থা তেমন স্বচ্ছল ছিল না। তদুপুরি তার পরিবারের লোক সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। যার ফলে মাঝে মধ্যে তাকে আর্থিক বিষয় অনেক অসুবিধায় পড়তে হত । তাছাড়া একবার মক্কায় ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল।

এ সময় হুযুর (সাঃ) মক্কার ধনাঢ্য মহিলা হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। তাই হুযুর (সাঃ)-এর আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালই ছিল। 
তিনি চাচা আবু তালিবের অর্থনৈতিক শোচনীয় অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন। 

এবং মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন, কিভাবে চাচা আবু তালিবের সংকট দূর করা যায় ।
তাই অনেক চিন্তা ভাবনা করে তিনি এক দিন তাঁর অপর এক চাচা আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট গমন করে বললেন, চাচা আসুন আমরা দু'জনে মিলে আবু তালিবের কোন প্রকার উপকার করতে পারি কি না? 

একারণে আমি মনে মনে স্থির করেছি যে, আমি তার এক সন্তানের লালন পালনের ভার বহন করব । আর অপর এক সন্তানের লালন পালনের ভার আপনি গ্রহণ করুন। এভাবে মনে হয় চাচা আবু তালিবের দুঃখ কিছুটা লাঘব হবে।

হুযুর (সাঃ)-এর প্রস্তাবে আব্বাস (রাঃ) ভীষণ খুশি হন এবং ভ্রাতা আব তালিবের এক সন্তানের লালন পালনের ভার নিজে নিয়ে নেন।
আর হুযুর (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-এর লালন পালনের দায়িত্ব ভারগ্রহণ
করেন ।
হযরত আলী (রাঃ) হুযুর (সাঃ)-এর সান্নিধ্যে আসার পর মুহূর্ত থেকেই তাঁর প্রধান সহচরে পরিণত হন। তিনি হুযুর (সাঃ)-এর নির্দেশ ছাড়া কোন কিছুই করতেন না ।

তাই দেখা যায় হুযুর (সাঃ) নবুয়ত প্রাপ্ত হওয়ার পর হযরত আলী (রাঃ)-এর নিকট প্রকাশ করা মাত্রই হযরত আলী (রাঃ) এক মুহূর্ত ও দেরী না করে হুযুর (সাঃ)-এর উপর ঈমান এনে মুসলমান হয়ে যান, এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র দশ বছর।
হযরত খাদিজা (রাঃ) যে সর্ব প্রথম ইসলাম গ্রহণকারিনী ছিলেন । এ বিষয় কারও কোন দ্বিমত নেই। তারপর বালকদের মধ্যে সর্ব প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী হলেন হযরত আলী (রাঃ)।

ইসলাম গ্রহণ

হুযুর (সাঃ)-এর আহবানে সাড়া দিয়ে বালকদের মধ্যে হযরত আলী (রাঃ) সর্ব প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন ।
হযরত আলী (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে এক হাদীসে উল্লেখ আছে, হুযুর (সাঃ) বলেছেন, আমি মুহাম্মদ সোমবার দিবসে নবুয়ত প্রাপ্ত হয়েছি। আর সেই সোমবারেই আমার সাথে প্রথম নামায আদায় করেন বিবি খাদিজা (রাঃ)। 

আর পর দিন মঙ্গলবার সবার আগে আমার সাথে নামায আদায় করেছিল হযরত আলী (রাঃ)। হযরত আলী (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করার পর এক দিন হুযুর (সাঃ)-এর সাথে নামায আদায় করতেছিলেন। ঘটনা চক্রে আবু তালিব তা দেখতে পান। 

তিনি ভাতিজা ও পুত্রকে এরূপ করতে দেখে কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলেন এবং নামায শেষে পুত্র আলীকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আলী তোমাদের ধর্ম কিরূপ ধর্ম? 
তোমরা যে কতিপয় আচার আচরণের মধ্যে নিরবতা পালন করে থাক। ইহার কোন প্রকার যৌক্তিকতা আছে কি?

পিতার প্রশ্নের জবাবে বালক আলী (রাঃ) দৃঢ়তার সাথে বললেন, হে পিতা! আমি আল্লাহর রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি। তিনি আমাকে যা আদেশ 
করেছেন, তাই আমি পালন করতেছি। এর অতিরিক্ত আমি আর কিছুই জানি না।

আবু তালিব পুত্র আলী (রাঃ) কথা শুনে বলেন, হে আমার স্নেহের পুত্র। আমি জানি মুহাম্মদ (সাঃ) তোমাকে কোন দিনও অন্যায় বা বিপথগামী করবেন
না । এরপর আবু তালিব সে স্থান ত্যাগ করে চলে গেল এবং পুত্রের জবাবে ভীষণ চিন্তাযুক্ত হন।