হযরত মা ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 8

হযরত মা ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 8

পূর্ববর্তী খলিফাদ্বয়ের আমলে হযরত আলী (রাঃ)-এর ভূমিকা

হযরত আলী (রাঃ) পূর্ববর্তী খলিফাদ্বয়ের সময় ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন। মুসলিম জাহানের উপর যখনই সংকট দেখা দিয়েছে তখন তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করে তা প্রতিরোধ করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তেন ।

প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর সময় তিনি খলিফার প্রধান পরামর্শ দাতাদের মধ্যে অন্যতম পরামর্শ দাতা ছিলেন ।
তাছাড়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যাস্ত ছিল। রাষ্ট্রীয় চিঠিপত্র যা খলিফার পক্ষ থেকে প্রেরণ করা হতো সেই দফতর পরিচালনার দায়িত্ব ও তাঁর উপর ন্যাস্ত ছিল।

যুদ্ধ বন্দীদের বিচারের ভার তাঁর উপর ন্যাস্ত ছিল। প্রথম খলিফার ইন্তেকালের পর দ্বিতীয় খলিফার খিলাফতের সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত তিনি খলিফার অন্যতম প্রধান সহচর ছিলেন। আর তিনিও মনে প্রাণে ইসলাম ও খলিফার সাহায্যে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। তাছাড়া খলিফা হযরত উমর (রাঃ) অন্যান্য সাহাবীদের পরামর্শ থেকে তাঁর মতামতকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন।

খলিফা উমর (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ)কে যে কি পরিমাণ গুরুত্ব দিতেন তা নিয়ে নিজেই বলেছেন আলী (রাঃ) না থাকলে নিশ্চয় উমর (রাঃ) ধ্বংস হয়ে
পড়ত। অনুরূপ ভাবে তৃতীয় খলিফার সময় হযরত আলী (রাঃ) ইসলামী খলিফার একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন। 

হযরত উসমান (রাঃ)-এর খিলাফত কালেও তিনি পূববর্তী খলিফাদ্বয়ের সময়ের ন্যায় কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য ছিলেন ।
কিন্তু পরবর্তী সময় খলিফা হযরত উসমান (রাঃ) ব্যক্তিগত সচিব কুচক্রী মারওয়ান খলিফাকে মহাজ্ঞানী হযরত আলী (রাঃ) থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। 

যার কারণে অনেক সময় খলিফা উসমান (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-এর মত ন্যায়পরায়ণ মহাজ্ঞানী ও বিচক্ষণ সাহাবীর পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যদি খলিফা উসমান (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ) বিচক্ষণতা অনুযায়ী সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন, তাহলে আমরা হয়তো মুসলিম জাহানের ইতিহাসকে অন্য রকম দেখতে পেতাম ।

খলিফা পদে হযরত আলী (রাঃ)-এর নির্বাচন

হযরত ওসমানের শাহাদাতের পর ইসলামী সাম্রাজ্যের সর্বত্র চরম অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। নূতন খলিফা নির্বাচনের প্রশ্নে পরস্পর বিরোধী যুক্তি তর্কের অবতারণা ও পদক্ষেপ গ্রহণের তৎপরতা চলতে লাগল ।

মিসরীয়রা হযরত আলীকে, কুফাবাসীরা যুবায়েরকে এবং বসরাবাসীরা তালহাকে সমর্থন করতে লাগল। হযরত আলী (রাঃ) খিলাফতের গুরুদায়িত্বভার গ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশের চেষ্টা করলেন। তিনি তালহা কিম্বা যুবায়েরকে খিলাফত গ্রহণের জন্য প্রস্তাব দিলেন। 

পরিশেষে অধিকাংশ মুহাজির ও আনসারদের চাপের মুখে এবং বন্ধু মহলের বিশেষ অনুরোধ ক্রমে তিনি খিলাফতের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করতে রাজী হলেন। হযরত উসমানের (রাঃ) মৃত্যুর ছয় দিন পর অত্যন্ত সংকটপূর্ণ মুহূর্তে হযরত আলী (রাঃ) খিলাফতের আসন গ্রহণ করেন ।

আল্লাহর কিতাব অনুসারে তিনি শাসন কার্য পরিচালনার শপথ লইলেন । প্রথমে তালহা ও যুবায়ের তার বিরোধিতা করলেও, পরে তাঁরা হযরত আলীকে খলিফা বলে মেনে নিলেন এবং তাঁর নিকট আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করলেন। হযরত আলীর হস্তে বাইয়াত গ্রহণের পর বিদ্রোহীরা স্ব স্ব স্থানে ফিরিয়া গেল ।

নির্বাচনের সমালোচনা

ইসলামী সাম্রাজ্যের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করলে বিদ্রোহীরা স্ব-স্থানে প্রত্যাবর্তন করল। ইতিমধ্যে ওসমানের হত্যার খবর সর্বত্র প্রচার হয়ে পড়ল। রাজধানী মদীনা নগরী তখন সম্পূর্ণ বিদ্রোহীদের হাতে ছিল। নির্বাচনের ব্যাপারে পর্যাপ্ত খোলাখুলিভাবে জনমত যাচাই করা সময় সাপেক্ষ এবং প্রায় অসম্ভব ছিল । 

অধিকাংশ মদীনাবাসী তাৎক্ষণিকভাবে হযরত আলীর নিকট আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করলেও একে অবাধ নির্বাচন বলা যায় না। 

তবে একথাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তখন দেশে বিরাজমান ছিল না। পূর্বে হযরত ওসমান যখন খলিফা পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন ওসমান ও আলীর মধ্যে মনোনয়ন সীমাবদ্ধ ছিল। হযরত আলী খলিফা পদে হযরত উসমান (রাঃ)-কে অধিকতর যোগ্য ব্যক্তি হিসাবে ভোট দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে উসমানকে যারা হত্যা করেছিল তাদিগকে স্বীকৃতির শর্তই ছিল হযরত আলীর (রাঃ) প্রতি আনুগত্যের বিলম্বের প্রধান কারণ। 

হযরত আলীর ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে তাদের কোন আপত্তি ছিল না । এবং খলিফা পদের যোগ্যতম ব্যক্তি বলে হযরত আলীকে (রাঃ) নির্বাচন করার লক্ষ্যে নির্দ্বিধায় ঐক্যমত প্রকাশ করেন ।

সিফফিনের যুদ্ধ

হযরত উসমানের হত্যার বিচারের প্রশ্নে সিরিয়ার গভর্ণর আমীর মুয়াবিয়ার দাবী অপরিবর্তিত রাখলেন। সিরিয়া প্রদেশের গভর্ণরের দায়িত্ব সর্বদাই উমাইয়াদের উপর ন্যাস্ত ছিল। প্রায় ২২ বৎসরের মত আমীর মুয়াবিয়া সেখানে গভর্ণর ছিলেন। হযরত আলী (রাঃ) খিলাফত লাভের পর অন্যান্য উমাইয়া শাসন কর্তাদের ন্যায় আমীর মুয়াবিয়াকেও গভর্ণরের পদ হতে অব্যাহতি দেন। বহুবিধ কারণে আলীর বিরুদ্ধে মুয়াবিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করে। 

বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) ইসলামের কল্যাণের জন্য ও মুসলিম সংহতি বজায় রাখার জন্য বিনা যুদ্ধে আভ্যন্তরিণ ছন্দু মিটাইয়া ফেলার উদ্দেশ্যে মুয়াবিয়াকে আহবান জানান এবং খলিফার প্রতি আনুগত্যের নির্দেশ দেন। কিন্তু মুয়াবিয়া হযরত উসমানের হত্যার প্রতিশোধ না নিয়া খাও হবেন না।

এ সংকল্প ঘোষণা করেন। মুয়াবিয়া হযরত উসমানের রক্তাক্ত বক্সাদী ও নিহত খলিফার স্ত্রী লায়েলার কর্তিত অংগুলি জনসাধারণকে দেখিয়ে তাদিগকে উত্তেজিত করে তুললেন।মুয়াবিয়ার এই অপপ্রচারে অসংখ্য লোক বিচলিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে তার পতাকা তলে সমবেত হল। ফলে তারা খলিফার আহবানের জবাবে উসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করল।

হযরত আলী (রাঃ) এই দাবি প্রত্যাখ্যান করলে উত্তের যুদ্ধের নয় মাস পরে মুয়াবিয়া খলিফার বিরুদ্ধে চূড়ান্তভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। পঞ্চাশ হাজার সৈন্য সহ হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন। 

৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ইউফ্রেটিশ নদীর পশ্চিম তীরে সিফফিন নামক স্থানে উভয় বাহিনী পরস্পরের মোকাবেলায় অবতীর্ণ হল। এ যুদ্ধের তৃতীয় দিনে উভয় পক্ষ মারাত্মক সংঘর্ষে লিপ্ত হল। এটা ছিল মুষ্ঠি যুদ্ধ। মুয়াবিয়া বিজয় সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়লেন। আমর বিন আসের উপদেশ ক্রমে এক নুতন কৌশল অবলম্বন করলেন। 

সিরিয়াবাসীরা বর্শাগ্রে কুরআন শরীফ ঝুলিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল : এখানে আল্লাহর কেতাব, ইহা আমাদের মধ্যে বিরোধ ফয়সালা করে দিবে। 
তারা আর যুদ্ধ করবে না এবং তাদের এ বিরোধ আল্লাহর আইনি দ্বারা মীমাংসা করা হবে। কি করে কুরআন শরীফ তাদের বিরোধ মিটিয়ে দিবে খলিফা তা জানবার জন্য আল-আসতারকে মুয়াবিয়ার নিকট পাঠালেন। 

মাবিয়া উত্তর দিলেন উভয় পক্ষের একজন করে সালিশ বা মধ্যস্থ ব্যক্তি নিযুক্ত করব এবং তারা কুরআনে নির্দেশিত পন্থায় আমাদের বিরোধ মিমাংসা করবেন।”
হযরত আলীর পক্ষ হতে আবু মুসা আসয়ারী এবং মুয়াবিয়ার পক্ষ হতে আমর বিন আস সালিম প্রতিনিধি মনোনীত হলেন। 

সিদ্ধান্ত হল উভয় সালিশের প্রত্যেকে চারশত লোক লইয়া সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী স্থানে মিলিত হবেন এবং কোরআনের নির্দেশ অনুসারে বিরোধ মিমাংসা করে দিবেন। প্রস্তাব অনুযায়ী আবু মুসা ও আমর বিন আস লোক সহ দওমাতুল জানদাল নামক স্থানে উপস্থিত হলেন। 

প্রকাশ্য মজলিস আরম্ভ হবার পূর্বে আবু মুসা এবং আমর বিন আসের মধ্যে গোপন আলোচনা হল । সালিশি মজলিশে উভয়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয় যে হযরত আলী ও মুয়াবিয়া উভয়কে খলিফা পদ হতে অপসারণ করতে হবে এবং অপর একজনকে খলিফা পদে নির্বাচন করতে হবে।

তবে খলিফা নির্বাচন তাদের এখতিয়ারভুক্ত ছিল না। মুসলমানদের সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে এই নির্বাচন হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই ঐক্যমতের সিদ্ধান্ত শুনানোর জন্য উভয়ে জন সম্মুখে আসলেন। আমর বললেন – যেহেতু আপনি বয়সে বড়, মর্যাদার দিক হতে উচ্চাসনে সমাসীন এজন্য আপনিই প্রথমে সিদ্ধান্ত শুনাইয়া দিন। 

আবু মুসা ঘোষণা করলেন, আমরা উভয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছি যে, আলী ও মুয়াবিয়া উভয়কে পদত্যাগ করতে হবে। জাতি নূতন করে নির্বাচনের অধিকারী হবে। আমর ইবনে আস বললেন, আবু মুসা তার নিজের লোককে অপসারণ করেছে, আমি তা সমর্থন করি এবং তদস্থলে মুয়াবিয়াকে যোগ্যতর গণ্য করে খলিফা হিসাবে ঘোষণা করতেছি। 

এই ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ল। আবু মুসা আশয়ারী এই গাদ্দারীতে অত্যন্ত ব্যথিত ও মর্মাহত হলেন। 
সকলেই নিজ নিজ স্থানে ফিরিয়া গেল । আমর ইবনে আস এবং সিরিয়াবাসী মুয়াবিয়ার হাতে বাইয়াত করে। 

খলিফা আলী (রাঃ) দওমাতুল জানদালের সিদ্ধান্ত মানিয়া নিতে অস্বীকৃতি জানায় ।
দওমাতুল জন্দলে খিলাফতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য সালিশ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে ১২০০০ সৈন্য বিশিষ্ট একটি দল খলিফা আলীর বাহিনী ত্যাগ করে হারুরা নামক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করে। ইহারা খারিজী অর্থ দলত্যাগী বা হারুনীয়া নামে পরিচিত। 

তারা মানুষের বিচারের প্রতি অস্বীকৃতি জানাইয়া আওয়াজ তুলে, “আল্লাহর আইন ছাড়া কোন আইন নাই (লা হুকমাহ ইল্লা লিল্লাহে)। 
তারা রাজনীতিতে গণতন্ত্রী এবং ধর্মে গোঁড়া ছিল। 

ঐতিহাসিক খোদা বক্স বলেন, “খারিজীগণ ইসলামের এমন একটি শুদ্ধাচারী সম্প্রদায় যারা ধর্মে গোড়া এবং রাজনীতিতে গণতন্ত্রমনা ছিল।”
সিফফিনের যুদ্ধে তিন মাস বিশ দিন উভয় পক্ষ যুদ্ধে অবস্থান করেছিলেন। পরস্পর ৯০টি সংঘর্ষ হয়েছিল। ইহাতে মুয়াবিয়ার ৪৫ হাজার এবং আলীর ২৫ হাজার সৈন্য প্রাণ হারায়।