হযরত মা ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 6

হযরত মা ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 6


ইসলামের খেদমত

হযরত আলী (রাঃ) অল্প বয়স্ক থাকা সত্ত্বেও তিনি ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। এমনি কি সর্বাবস্থায় হুযুর (সাঃ)-এর সাথে একান্ত আপনজনের ন্যায় সাথী হয়ে থাকতেন ।
বাল্যকালেই তিনি হুযুর (সাঃ)-এর আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছেন, তাই পরবর্তী জীবনেও দেখা যায় তিনি হুযুর (সাঃ) জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। 

বরং তিনি নিজের জীবনকে অনেক তুচ্ছ মনে করতেন। হুযুর (সাঃ) মক্কাবাসীদের নিকট ইসলামের বাণী প্রচারের কারণে কুরাইশরা মারমুখী হয়ে উঠল। যার পরিণতিতে মুসলমানদের উপর নেমে আসল অত্যাচারের স্টীম রোলার। এমন কি মক্কাবাসীরা হুযুর (সাঃ)-কে ও প্রাণে মারার ষড়যন্ত্র করে বসল ।

তাই তারা রাঁতের অন্ধকারে হুযুর (সাঃ)-কে হত্যা করা স্থির করল। বলাবাহুল্য মক্কাবাসীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক আগ থেকেই মুসলমানগণ আবসিনিয়াতে হিজরত করতে লাগলেন । 

পরবর্তী সময় মদীনাবাসীগণ মুসলমানদেরকে মদীনায় আসার আমন্ত্রণ জানালে মুসলমানগণ ক্রমান্বয়ে মদীনাতে হিজরত করতে শুরু করলেন। কুরাইশদের গোপন ষড়যন্ত্রের কথা মহান আল্লাহ তায়ালা হুযুর (সাঃ)-কে ওহী মারফতে জানিয়ে দেন এবং তাঁকে মদীনা অভিমুখে হিজরত করার আদেশ করলেন ।

আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে হুযুর (সাঃ) মদীনা যাওয়ার সকল প্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন । এবং হযরত আলী (রাঃ)কে বললেন, আজ রাতে তুমি আমার বিছানায় আমার এ চাদর মুড়ি দিয়ে শুইয়ে থাকবে ।

হযরত আলী (রাঃ) এ সংবাদ শুনে বিন্দুমাত্রও বিচলিত হননি। কারণ তাঁর নিকট নিজের জীবনের চেয়ে হুযুর (সাঃ) প্রাণের মূল্য অনেক বেশি ছিল। তাই তিনি হুযুর (সাঃ)-এর প্রস্তাবে রাজী হয়ে যান। হুযুর (সাঃ) তাঁর নিকট গচ্ছিত যাবতীয় আমানতসমূহ তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, আগামী দিন সকালে তুমি এগুলো যথাযথভাবে মালিকদের নিকট পৌঁছে দেবে।

হুযুর (সাঃ) নির্দিষ্ট সময়ে অতি গোপনীয়ভাবে গৃহ ত্যাগ করে মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। এদিকে হযরত আলী (রাঃ) হুযুর (সাঃ) নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে নির্ভয়ে শুয়ে পড়লেন।
অপর দিকে কুরাইশরা তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সারা রাত পাহারা দিতে থাকল যে, রজনী প্রভাতে মুহাম্মদ (সাঃ) যখন ঘর থেকে বের হবেন, তখন তারা সম্মিলিতভাবে তাকে হত্য করে ফেলবে।

কিন্তু ভোর বেলায় হুযুর (সাঃ)কে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে না দেখে তারা ঘরে ঢুকে দেখতে পেল যে, মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিছানায় সিংহ পুরুষ আলী (রাঃ) নির্ভয়ে ঘুমিয়ে আছে। মুহাম্মদের বিছানায় আলী (রাঃ)কে এভাবে শুইয়ে থাকতে দেখে তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ল। তারা কিছুই স্থির করতে পারলনা যে কি হতে কি হয়ে গেল ।

কুরাইশ নেতা আবু জেহেল রুদ্ধমূর্তি ধারণ করে হযরত আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল ।
আলী বল! মুহাম্মদ (সাঃ) কোথায়? যেমনি প্রশ্ন তেমনি উত্তর ।
হযরত আলী (রাঃ) অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বললেন, আমি কি জানি কোথায়? তোমাদের প্রয়োজন থাকলে তোমরা খুঁজে দেখতে পার মুহাম্মদ (সাঃ) কোথায়
আছে?

হযরত আলী (রাঃ)-এর জবাব শুনে কুরাইশ নেতা আবু জেহেলের মাথায় যেন বজ্রাঘাত পড়ল। সে বুঝতে পারল যে, শিকার তাদের হাত ছাড়া হয়ে পড়ছে। তাই তারা কাল বিলম্ব না করে শিকার ধরার জন্য চারদিকে ছড়িয়ে
পড়ল ।

অতঃপর হযরত আলী (রাঃ) হুযুর (সাঃ)-এর পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর নিকট প্রদত্ত আমানতসমূহ স্বস্ব মালিকদের নিকট পৌঁছে দিয়ে ইতিহাসে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এর পর তিনি মাত্র তিন দিন মক্কাতে অবস্থান করেন। চতুর্থ দিনে তিনিও গোপনে মক্কা ত্যাগ করত মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। 

হুযুর (সাঃ)-এর সাথে ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন

হুযুর (সাঃ) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পর সর্ব প্রথম ছিন্ন মূল মুসলমানদের পুনর্বাসনের প্রতি মনোযোগ দেন, কারণ মক্কা থেকে মদীনায় আগত মুসলমানগণ ছিলেন রিক্ত হস্ত। কারণ তারা মক্কা থেকে সাথে করে কিছুই আনতে পারেননি। তাছাড়া মদীনার অধিকাংশ লোকই ছিলেন কৃষি জীবি । 

অপর দিকে মক্কাবাসী লোকজন কৃষি কাজে অনভিজ্ঞ ছিলেন বলে, তারা ভীষণ অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন। মদীনার স্থায়ী বাসিন্দাগণ আর্থিক অসুবিধায় থাকা সত্ত্বেও মক্কা থেকে আগত মুসলমানদেরকে প্রাণপণে সাহায্য সহায়তা করেছিলেন। 

মদীনার লোকজন মক্কা থেকে হিজরত কালীন মুসলমানদের সাথে যে সৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যই তা একটি দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। মহানবী (সাঃ) মদীনায় আসার পর সর্ব প্রথম মক্কা থেকে আগত মুসলমান ও মদীনাবাসীদের মধ্যে স্থায়ী সম্পর্ক গঠন করার কাজে মনোনিবেশ করেন। 

তাই তিনি একজন আনসার ও একজন মুহাজিরের মধ্যে ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন করেন। ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন কালে আনসার মুহাজির উভয়ের মধ্যে বংশ মর্যাদা শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রেখেছেন ।
এভাবে তিনি মক্কা থেকে আগত সকল মুহাজিরদের সাথে মদীনাবাসী আনসারদের ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন করেন। 

কিন্তু একমাত্র অবশিষ্ট রয়ে যান হযরত আলী (রাঃ)। তাঁর সাথে কারও ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন করে দেননি। তাই তিনি মনে মনে ভীষণ দুঃখিত হয়েছেন ।
কথিত আছে আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন সম্পর্কে হযরত উমর (রাঃ) বলেন, হুযুর (সাঃ) মক্কা থেকে আগত সকল মুহাজিরদের সাথে মদীনাবাসী আনসারদের ভ্রাতৃ সম্পর্ক গঠন করেছেন। 

কিন্তু একমাত্র অবশিষ্ট রয়ে যান হযরত আলী (রাঃ)। কারণ তার সাথে কারও ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন করানো হয়নি। তাই তিনি ব্যথিত মনে হুযুর (সাঃ)-এর নিকট গমন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ভ্রাতৃ সম্পর্ক পাতান থেকে আমাকে কেন বঞ্চিত করলেন?

হযরত আলী (রাঃ)-এর আবেগ তাড়িত প্রশ্নের জবাবে হুযুর (সাঃ) বললেন যে, আল্লাহর রাসূলের সাথে যার ইহ ও পরকালের ভ্রাতৃ সম্পর্ক গঠন করে রাখা হয়েছে। তার কি আর অন্যের সাথে ভ্রাতৃ সম্পর্ক গড়ার প্রয়োজন আছে? হযরত আলী (রাঃ) হুযুর (সাঃ) এ উক্তি শুনে খুশীতে আটখানা হয়ে পড়লেন ।

তারপর হুযুর (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-এর হাত ধরে উপস্থিত জনতার
সামনে এনে বললেন, হে আল্লাহ! এই ব্যক্তি আমার একান্ত আপনজন । আর আমিও তার একান্ত আপন জন ।

হাদিসে বর্ণিত আছে —হুযুর (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বললেন, হে আলী! হযরত হারুণ (আঃ)-এর সাথে হযরত মুসা (আঃ)-এর যেরূপ সম্পর্ক, তোমার ও আমার সাথে অনুরূপ সম্পর্ক।
অপর এক হাদিসে বর্ণিত আছে—হুযুর (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আলী কে ভালবাসে সে যেন আমাকে ভালবাসল। আর আমিও তাকে ভালবাসী অপর এক হাদিসে বর্ণিত আছে হুযুর (সাঃ) বলেছেন, “আলী আমার থেকে আর আমি আলী থেকে" ।

বিভিন্ন রণাঙ্গনে হযরত আলী (রাঃ)-এর বীরত্ব

হযরত আলী (রাঃ)-এর উপাধী ছিল “আসাদুল্লাহ” অর্থাৎ আল্লাহর সিংহ। প্রকৃতপক্ষে সত্যই তিনি জগত বিখ্যাত বীর যোদ্ধা বলে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাঁর বীরত্বের বাস্তব ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
মহানবী (সাঃ)-এর জবদ্দশায় একটি যুদ্ধ ব্যতিত সব কয়টি যুদ্ধে তিনি যোগদান করেছেন। 

যুদ্ধের ময়দানে তিনি যেরূপ অসীম সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছেন, তাই তাঁকে অতুলনীয় বীরত্বের খেতাব দান করেছে। যুদ্ধের ময়দান যত বড় বীর যোদ্ধা হউক না কেন শের-ই-খোদা হযরত আলী (রাঃ)এর নাম শুনা মাত্রই সে ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে পড়ত। 

দ্বন্দ্ব যুদ্ধে তাঁর সাথে মোকাবিলা করতে এসে প্রাণ নিয়ে কেহ যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করেছে একথা কেউ বলতে পারবে না। যুদ্ধের ময়দানে তিনি যেমনি ছিলেন সাহসী, তেমনি ছিলেন অতি সতর্কতা অবলম্বনকারী সুদক্ষ সৈনিক। সাধারণতঃ তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির বীরযোদ্ধা, যুদ্ধ যতই ভয়াবহ হউক না কেন, যে কোন অবস্থায় তিনি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারতেন, যা সকলের পক্ষে সম্ভব ছিল না। 

যুদ্ধ ক্ষেত্রে তিনি কোন দিনও দেহের পশ্চাত ভাগে বর্ম পরিধান করতেন না এবং যুদ্ধের মাঠে পিছনে ফিরে তাকাতেন না ।
ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, বদরের যুদ্ধে হযরত আলী (রাঃ) যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন, তা সম্পূর্ণ অকল্পনীয়।

বদরের যুদ্ধে হযরত আলী (রাঃ) একাই পরপর একুশ জন কুরাইশ বীর যোদ্ধাকে হত্যা করেছেন। হযরত আলী (রাঃ) বদরের সূচনা লগ্নে দ্বৈরথযুদ্ধে কুরাইশ নেতা বীর যোদ্ধা ওয়ালিদকে প্রথম আঘাতেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।

বদরের যুদ্ধের ন্যায় উহুদের যুদ্ধে ও হযরত আলী (রাঃ) অতুলনীয় বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন। এ যুদ্ধে ও তিনি একাই সাত জন কুরাইশ বীর যোদ্ধা কে হত্যা করেছেন।
উহুদের যুদ্ধের মাঠ থেকে ফিরে এসে 'হুযুর (সাঃ) স্বীয় কন্যা হযরত ফাতেমা (রাঃ)কে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে ফাতেমা ধর! আমার এ তরবারী ধৌত করে ইহাকে পরিস্কার করে ফেল। 

কারণ এ তরবারী দ্বারা আজ আমি খাঁটি মুসলমান হয়েছি ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক বলেন, উহুদের যুদ্ধের দিনে প্রথম যে বাতাস প্রবাহিত হয়েছিল, সে বাতাসের মধ্যে হযরত আলী (রাঃ) স্পষ্ট ধ্বনি শুনতে পান যে, কেউ যেন বলছেন, যুলফিকারের ন্যায় অন্য কোন তরবারী নেই । 

আর হযরত আলী (রাঃ) ন্যায় আর কোন বীর নেই। সহী আল-বোখারীতে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, উহুদের যুদ্ধের মাঠে মক্কাবাসীদের পতাকাবাহী তালহা ইবনে আবু তালহা স্বীয় বাহিনী হতে সামনে অগ্রসর হয়ে গর্ব ভরে মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, হে মুহাম্মদের অনুসারীগণ। 

তোমরা মনে করছ যে, কুরাইশদের কোন সৈনিক তোমাদের হাতে নিহত হলে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আর আমাদের হাতে তোমাদের কোন সৈনিক প্রাণ হারালে স্বর্গে গমন করবে।
যদি তোমাদের ঐ ধারণা সত্য হয়ে থাকে। তাহলে আস, আমার সাথে মোকাবেলা করতে আস।

আবু তালহার কথা শুনে হযরত আলী (রাঃ) স্থির থাকতে পারলেন না তাই তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে নরাধম পাপিষ্ট! আয় আমি তোকে আমার এ তরবারী দ্বারা জাহান্নামে না পৌঁছানোর পূর্বে যুদ্ধের মাঠ থেকে ফিরে যাব না। মুহূর্তের মধ্যে আরবের খ্যাতনামা বীরদ্বয়ের মধ্যে মল্ল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। 

অল্পক্ষণ পরে শের-ই-খোদা মহাবীর হযরত আলী (রাঃ) তার জীবন নাশ করতে উদ্যত হন, কিন্তু তালহা অত্যন্ত বিনীত ভাবে মহাবীর আলী (রাঃ)কে লক্ষ্য করে বলল, হে আলী! তোমার খোদার কসম। আমাকে হত্যা করবে না। 

বরং আমি তোমার ন্যায় মহৎ বীরের নিকট প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছি। মহান আল্লাহর নামে শপথ করায় হযরত আলী (রাঃ) তালহাকে হত্যা করলেন না। শিবিরে এসে মুজাহিদগণ তাঁর প্রতি অসন্তুষ্টির ভাব প্রকাশ করলেন।

হুয়ুর (সাঃ) এ ঘটনা শুনার পর বললেন, তালহার প্রাণ কখনও রক্ষা হবে পর মুহূর্তে হুযুর (সাঃ)-এর বানী বাস্তবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। অল্পক্ষণ পরেই তালহা নিহত হয়েছিল।
উহুদের যুদ্ধে হযরত আলী (রাঃ) অসীম সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছেন, কুরাইশ বাহিনী পরপর যে কয়েকজনকে পতাকা বাহী নিযুক্ত করেছিল, তাদের সব কয়জনকে হযরত আলী (রাঃ) একাই হত্যা করেছেন।

উহুদের যুদ্ধের সময় হুযুর (সাঃ) নিজেই হযরত আলী (রাঃ)-এর হাতে পতাকা তুলে দিয়ে বললেন, হে আলী! তুমি আমার এ পতাকা ধারণ কর। নিশ্চয় স্মরণ রাখিও পরকালেও তুমিই আমার প্রধান পতাকা বাহী হবে। হিজরী পঞ্চম সনে হযরত আলী (রাঃ) খন্দকের যুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

হুযুর (সাঃ) মক্কার কুরাইশ বাহিনী কর্তৃক মদীনা আক্রমণের সংবাদ পেয়ে হযরত সালমান ফারসী (রাঃ)-এর পরামর্শ অনুযায়ী মদীনার তিন দিকে গভীর পরিখা খনন করেন। কুরাইশ বাহিনী যথা সময় মদীনার নিকটবর্তী হয়ে মুসলমানদের রণকৌশল দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। 
কুরাইশদের এবারের বাহিনী ছিল সম্মিলিত বাহিনী, তাছাড়া এ যুদ্ধে আরবের কতিপয় বীরযোদ্ধা ও অংশ গ্রহণ করেছিল। তাদের মধ্যে আমর ইবনে আবুদ্দার ছিল অসীম সাহসী বীরযোদ্ধা তার প্রতিদ্বন্দ্বি বলতে আর কেউ ছিল না ।

সে কতিপয় অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে যেখানে পরিখা কিছুটা সংকীর্ণ ছিল, সে স্থান দিয়ে লম্পঝম্প দিয়ে পরিখা অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকে পড়ল এবং মুসলমানদেরকে নানা প্রকার তিরস্কার করে দর্পভরে কটূক্তি করতে লাগল । তার সাথে স্বপুত্র হাসান ও আবু জেহেল তনয় ইকরামা ছিল।

আমরের গর্বোক্তি শুনে মহাবীর হযরত আলী (রাঃ) আর স্থির থাকতে পারলেন না, তাঁর সমস্ত দেহ টগবগ করতে লাগল। তিনি বার বার হুযুর (সাঃ)-এর নিকট অনুমতি চাইতে লাগলেন।
হযরত আলী (রাঃ)-এর অবস্থা দেখে হুযুর (সাঃ) বললেন হে আলী! শান্ত হও! তুমি কি তার নাম শুননি। যে সে আমর ইবনে আবুদ্দার। জবাবে হযরত আলী (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সে যেই কেউ হউক না কেন তাতে কি আসে যায়। আপনি আমাকে আল্লাহর নামে অনুমতি দিন।

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মহাবীর আলী (রাঃ)-এর মনের অবস্থা দেখে বললেন, যাও আলী! আমি তোমাকে আল্লাহর নাম নিয়ে শত্রুকে নিধন করার জন্য অনুমতি দিচ্ছি। এ বলে হুযুর (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-এর মাথায় স্বহস্তে দিস্তরে বেধে দেন।

মূহুর্তের মধ্যে বীর কেশরী আলী (রাঃ) আমরের সামনে এসে হাযির হন এবং বজ্রকণ্ঠে হায়দারী হাকে আমরের উল্লাস ধ্বনি থামিয়ে দেন এবং আমরকে লক্ষ্য করে বজ্রকণ্ঠে হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ওরে পাষন্ড। তোমার সামনে কে এসেছে ভাল করে দেখে নাও। আর নিশ্চিত জেনে রাখ । আমার হাত থেকে তোমাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না ।

হযরত আলী (রাঃ)-এর কথা শুনে নরপিশাচ আমর বলল । হে আলী! আমি চাই না যে, আমার হাতের এ বর্শা তোমার বক্ষ ভেদ করুক। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক কেননা তুমি আমার পিতার বন্ধুর পুত্র। তাই আমি তোমাকে অনুরোধ করে বলছি। তুমি তোমার প্রাণ নিয়ে এখান থেকে চলে যাও। বরং তোমার চেয়ে অন্য কোন সাহসী যোদ্ধাকে আমার সামনে পাঠিয়ে দাও ।

বীর কেশরী হযরত আলী (রাঃ) আমরের কথা শুনে বললেন, হে আমর! তুমি ও যে আমার পিতার বন্ধুর পুত্র তা অবশ্যই আমি জ্ঞাত আছি। তবে আমি তোমাকে একটা উত্তম পরামর্শ দিচ্ছি। আর তাহলো তোমার এখনও সময় আছে। কালেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ কর। তাহলে তোমার
মঙ্গল হবে।

হযরত আলী (রাঃ)-এর কথা শুনে আমর বলল। এতে আমার কোন প্রয়োজন নেই। এ কথা শুনে বীর কেশরী হযরত আলী (রাঃ) বললেন, যাক আমি তোমাকে এবারের মত ছেড়ে দিলাম, তুমি এ স্থান ত্যাগ করে চলে যাও। এবং তোমার আরও যে কয়েকজন সঙ্গী সাথী আছে তাদেরকেও নিয়ে যাও। তোমার মঙ্গল হবে।

হযরত আলী (রাঃ)-এর কথা শুনে আমর বলল । হে আলী যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করা প্রকৃত বীর যোদ্ধার জন্য লজ্জাকর ব্যাপার। এবার হযরত আলী (রাঃ) বজ্রকণ্ঠে হায়দারী হুঙ্কার দিয়ে বললেন।  যদি সাহস থাকে তাহলে অশ্ব হতে নেমে কিন্তু হোদাইবিয়া নামক স্থানে এসে সংবাদ পান যে, মক্কাবাসী কুরাইশগণ মুসলমানদেরকে কোন মতেই মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। প্রয়োজনে তারা যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত আছে।

হুযুর (সাঃ) স্বীয় উদ্দেশ্য মক্কাবাসীদেরকে জ্ঞাত করানোর উদ্দেশ্যে হযরত *উসমান (রাঃ)কে দূত হিসেবে মক্কাতে প্রেরণ করলেন ।
কিন্তু নির্ধারিত সময় হযরত উসমান (রাঃ) মক্কা থেকে ফিরে না আশায় হুযুর (সাঃ) চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লেন । 

ইত্যবসরে মুসললমানদের মধ্যে গুজব রটে গেল যে, মক্কাবাসী কুরাইশগণ হযরত উসমান (রাঃ)কে হত্যা করে ফেলেছে ।
হুযুর (সাঃ) এ সংবাদে অত্যন্ত মর্মাহত হন, এবং সঙ্গীসাথী সকল সাহাবীদেরকে নিয়ে হাতে হাত রেখে হযরত উসমান (রাঃ)-এর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। 

ইসলামের ইতিহাসে উক্ত শপথ অনুষ্ঠান ‘বাইয়াতে রেদওয়ান' নামে পরিচিত
ইতিমধ্যে হযরত উসমান (রাঃ) ও মক্কা থেকে ফিরে এসে হুযুর (সাঃ)-এর সাথে মিলিত হন ।
যাক শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর কুরাইশগণ মুসলমানদের সাথে সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষর করতে রাজী হয়। 

হুযুর (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে সন্ধিপত্র লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দেন। তিনি নির্দেশ অনুযায়ী মুসলিম পক্ষ প্ৰধান মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নামের সংগে আল্লাহর রাসূল শব্দটি লিপিবদ্ধ করলেন।


ইহাতে মক্কাবাসীরা ভীষণ ক্ষেপে গেল, তারা বলল না এটা কিছুতেই হতে পারে না। মুহাম্মদ (সাঃ)-কে যদি আমরা আল্লাহর রাসূল বলেই স্বীকার করে নেই, তাহলে তো আর তার সাথে আমাদের কোন বিরোধ থাকার কথা নয়। কুরাইশদের আপত্তির মুখে হুযুর (সাঃ) নিজে হযরত আলী (রাঃ)কে “আল্লাহর রাসূল” শব্দটি বাদ দিয়ে দিতে বললেন।

হযরত আলী (রাঃ) বললেন, এটা আমার দ্বারা কখনও সম্ভব হবে না । আমি যে হাত দ্বারা আল্লাহর রাসূল শব্দটি লিপিবদ্ধ করেছি। সে হাত দ্বারা আল্লাহর রাসূল” শব্দটি মুছে ফেলতে পারব না ।
হুযুর (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ)এর মনোভাব জানতে পেরে বললেন, হে আলী! আমাকে “আল্লাহর রাসূল” এ শব্দটি দেখিয়ে দাও। আমি নিজের হাতেই তা মুছে ফেলে দেব।

হুযুর (সাঃ) নিজ হাতে “আল্লাহর রাসূল” শব্দটি মুছে ফেললেন । হোদাইবিয়ার সন্ধির শর্তাবলী বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদিও মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময় উক্ত সন্ধি চুক্তিই মুসলমানদের জন্য চূড়ান্ত বিজয়ের সূচনা করেছিল ।