হযরত মা ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 9

হযরত মা ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 9

উষ্ট্রের বা জামালের যুদ্ধ

হযরত আলীর খিলাফত লাভের অব্যবহিত পরেই তালহা ও যুবায়ের খলিফার নিকট উসমান হত্যার বিচার দাবী করেন। হযরত উসমানের
শাহাদাতের সময় হযরত আয়েশা, উম্মে ছালমা, হাফছা (রাঃ) মদীনায় ছিলেন না। হজ্জের উদ্দেশ্যে তারা মক্কায় গিয়েছিলেন। মক্কা হতে প্রত্যাবর্তনের পথে তারা এই সংবাদ অবগত হন। মারওয়ান সহ কয়েকজন অপসারিত গভর্ণর তাদের সংগে উত্তেজিত হয়ে খলিফা হত্যার বিচারের দাবী করেন। 

উম্মে ছালমা ও হাফছা একমত হতে না পেরে মদীনা চলে যান এবং হযরত আলীকে অবস্থা অবগত করান। হযরত আয়েশা তালহা ও যোবায়ের ১৫০০ সৈন্যসহ খলিফার বিরুদ্ধে রওয়ানা হলেন। সংবাদ পেয়ে হযরত আলী (রাঃ) শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে ২০০০০ হাজার সৈন্য সহ বসরা অভিমুখে যাত্রা করলেন। শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত গৃহিত হল যে, সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরিণ শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে হত্যাকারীদের বিচার করা হবে। 

কায়কার মধ্যস্থতায় মীমাংসার আলোচনা চলতে থাকে। কিন্তু মুনাফিক ইবনে সাবার সমর্থকগণ রাতের অন্ধকারে হযরত আয়েশার ফৌজের উপর আক্রমণ চালায়। হঠাৎ গোলযোগের কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তালহা ও যোবায়েরকে জানানো হয় আলীর ফৌজেরা আক্রমণ করেছে। তারা মন্তব্য করলেন – “আফসোস আলী (রাঃ) মুসলমানদের রক্তারক্তি হতে বিরত হল না। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ আরম্ভ হল। 

রাত্রি অন্ধকারে কোন দল প্রথম আক্রমণ করেছে তা নির্ধারণ করতে না পেরে একদল অন্যদলকে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা চালাল। প্রভাতে উভয় পক্ষের আক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করল। হযরত আয়েশা উটের পিঠে উপবিষ্ট হয়ে যুদ্ধের পরিস্থিতি অবলোকন করতে থাকলেন। সাত দিন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধ চলতে থাকল । কাব ইবনে মুর আয়েশাকে বললেন, “অন্যায় ভাবে যুদ্ধ হচ্ছে, এখন যুদ্ধ বন্ধের আদেশ দিন।” আয়েশা যুদ্ধ মূলতবী নির্দেশ জারি করলেন। 

এ যুদ্ধে দশ হাজারের মত মুসলমান শাহাদাতবরণ করেন। যুদ্ধ শেষে খলিফা আলী (রাঃ) ঘোষণা করলেন, পলায়নপর কারও উপর আক্রমণ করিও না। কোন আহতকে হত্যা করবে না। কাউকেও বন্দী করবে না। কারও কোন জিনিস জোরপূর্বক দখল করবে না। হযরত আয়েশা স্বয়ং এ যুদ্ধে উটের পিঠে অবস্থান করে সৈন্য পরিচালনা করেছিলেন বলে এই যুদ্ধকে “জঙ্গে জামাল” বা “উষ্ট্রের যুদ্ধ” বলা হয়। শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে আলীর পক্ষ বিজয়ী হল । 

খলিফা হযরত আয়েশাকে মায়ের ন্যায় সম্মান করতেন। তারা পরস্পর ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অতঃপর খলিফা হযরত আলী (রাঃ) উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা (রাঃ)কে যথাযোগ্য সম্মান সহকারে তদীয় ভ্রাতা মুহাম্মদ বিন আবু বকরের পাহারাধীন মদীনায় পাঠিয়ে দেন । এভাবে উষ্টের যুদ্ধ শেষ হল ।

খারেজী আন্দোলন ও নাহরাওয়ানের যুদ্ধ

সিফফিনের যুদ্ধের পরিণাম ও দওমাতুল জান্দালের সালিশি সিদ্ধান্তের প্রতি ঐক্যমত প্রকাশে অপরাগতার কারণে ১২০০ সৈন্যের একটি দল আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব আর রাসিবী নামক একজনের নেতৃত্বে খারেজী আন্দোলন শুরু করে। 

খারেজী অর্থ দল ত্যাগী। তারা আলী (রাঃ) কিম্বা মুয়াবিয়া কোন ব্যক্তিকে খলিফা হিসাবে মানতে রাজী হল না । তারা আবু বকর এবং ওমরকেই খলিফা হিসাবে মান্য করে এলান করে দিল আল্লাহ ছাড়া আর কারও শাসন নাই । তারা গোত্র বংশ নির্বিশেষে সার্বজনীন জনমতের ভিত্তিতে ইমাম বা খলিফা নির্বাচনের পক্ষপাতী ছিল ।

খারেজীগণ হযরত আলীর দল ত্যাগ করে অপপ্রচার ও বিক্ষোভ শুরু করে। ইরাক ও ইরানে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বাগদাদের নিকটবর্তী নাহারাওয়ানে সমবেত হয়। তারা তাদের মত বিরোধী মুসলমানদিগকে হত্যা করত। তাদের যথাসর্বস্ব লুণ্ঠন করে গৃহে অগ্নিসংযোগ করত। তাই হযরত আলী (রাঃ) মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনী প্রেরণের পরিবর্তে খারেজীদের মোকাবিলার উদ্দেশ্যে নাহারাওয়ানে প্রেরণ করেন।

খলিফার সৈন্যগণ খারেজীদের উপর আক্রমণ করে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। কিছু সংখ্যক খারিজী অনুতপ্ত হয়ে খলিফার পক্ষে যোগদান করে। অবশিষ্ট খারেজীগণ পরাজিত হয়ে কোন ক্রমে প্রাণ লইয়া বাহরাইন ও আল আহমা প্রদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। এভাবে নাহারাওয়ানের যুদ্ধে খারেজীরা খলিফা আলীর (রাঃ) নিকট পরাজয় বরণ করেন।

হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর বিবাহের পয়গাম বা প্রস্তাব

নবী দুলালী খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমাতুজ জোহরা (রাঃ) আনহার পবিত্র মদীনা শরীফ গমন করার পর থেকেই বিবাহের প্রস্তাব আসা শুরু হল। বহুদূর দুরান্তে হতে শিক্ষিত ধনাঢ্যবান ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুদর্শন যুবক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর আদরের দুলালী কলিজার টুকরা হযরত ফাতেমাতুজ জোহরাকে (রাঃ) বিবাহ বন্দনে আবদ্ধ করার জন্য অধীর আগ্রহে প্রস্তাব পাঠাতে লাগলেন। 

এমন কি আনসার ও মুহাজিররা প্রিয় নবী (সঃ)-এর জন্য জীবন উৎসর্গ করেও নবী কন্যা ফাতেমাকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। বিভিন্ন স্থান হতে প্রস্তাব আসলেও মহানবী কাউকে কোনরূপ কথা না দিয়ে মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন। কে দিতে পারবে আমার আদরের কন্য নয়নের মণি কলিজার টুকরা হযরত ফাতেমা তুজ জোহরার ইজ্জত ও সম্মান। 
প্রিয় নবী (সঃ) দিবা রাত্রে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করলেও তার মনের মধ্যে কেবল লুকোচুরি করতেছে হযরত ফাতমার বিবাহ জল্পনা কল্পনা। বিভিন্ন স্থান হতে নামী দামী প্রস্তাব আসলেও প্রিয় নবী (সঃ)-এর মনের একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে কার কাছে বিবাহ দিলে তার দীন ঈমান ও ইজ্জত আবরু রক্ষা পাবে। আল্লাহর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সঃ) নবী দুলালী ফাতেমাকে মূলত এমন একজন সৎ, যোগ্য জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, শিক্ষিত আল্লাহভীরু ন্যায়পরায়ণ বিচক্ষণবান ও সম্ভ্রান্ত ছোলের কাছে অর্পণ করতে প্রিয় নবী (সঃ)-এর মনের একান্ত প্রত্যাশা। 

দূর দূরান্ত হতে যত প্রস্তাবই আসুক না কেন কোন পাত্রই প্রিয় নবী (সঃ)-এর চিন্তাও আশা অনুযায়ী হয় না যার কারণেই কাউকে কোন রূপ কথা না দিয়ে চুপ করে থাকেন। মূলত আল্লাহর হাবীব প্রিয় নবী (সঃ) তার কলিজার টুকরার জন্য কোন ধনাঢ্যবান পাত্র চান না। 

তিনি চান প্রকৃত ঈমানদার গরীব নবী দুলালী হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর শরীরের গঠন প্রকৃতি, সৌন্দর্য রূপগুণ ভদ্রতা, নম্রতা আচার ব্যবহার কথাবার্তা দানশীলতা, আতিথেয়তা, আমানতদারী, পিতা মাতার আনুগত্যতা, ইবাদত গুজার, আল্লাহ ভীরুতা, তাকওয়া সুতীক্ষ্ম প্রজ্ঞা, চাল-চলন, কর্ম সস্পৃহা, শোয়া-বসা খাওয়া-পরা, শিক্ষা-দীক্ষা, আদব- আখলাক, ধৈর্য্য সবর, ধ্যান তপস্যা তাওয়াক্কুল ইত্যাদি রকমের মহৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রায় সকল সাহাবীরই জানা ছিল। 

যার কারণেই তাদের মধ্য হতে অনেকেই নবী দুলালী হযরত ফাতেমা (রাঃ)-কে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে পাওয়া জন্য সরাসরি প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর পবিত্র দরবারে উপস্থিত হয়ে বুক ভরা আশা নিয়ে প্রস্তাব দিতেন। উল্লেখ যোগ্যদের মধ্য হতে সর্ব প্রথম হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর পর হযরত উমর ফারুক (রাঃ) নবী দুলালী কলিজার টুকরা হযরত ফাতেমার (রাঃ)-কে বিবাহ করার জন্য আবেদন পেশ করলেন। তাদের বিশেষ আবেদন শুনা সত্ত্বেও প্রিয় নবী (সঃ) তাদের আবেদনের কোন জবাব দিলেন না। 

পরিশেষ সত্যের সৈনিক শেরে খোদা হযরত আলী (রাঃ) আবেদন করলেন। হযরত আলী (রাঃ) আবেদন করার সাথে সাথে প্রিয়নবী (সঃ) বললেন বিবাহের মোহরানা আদায় করার মতো তোমার নিকট কি আছে? তখন হযরত আলী (রাঃ) বলিলেন একটি ঘোড়া ও একটি বর্ম ছাড়া আর কিছুই নেই। হযরত আলী (রাঃ)-এর সাহসী মনের সাহসী কথা শুনে প্রিয় নবী হযরত (সঃ) বললেন যুদ্ধের জন্য অবশ্যই ঘোড়া দরকার বিধায় তুমি বর্মটি বিক্রি করতে পার। 

এরপর অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে হযরত আলী আদবের সাথে সেখান হতে বিদায় নিয়ে গেলেন ।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকাগণ একটু চিন্তা করে দেখুন প্রিয় নবী (সঃ) যেমনি যোগ্য তার মনের মত পাত্র চেয়েছিলেন রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তায়ালা তাই মিলায়ে দিলেন।