হযরত মা ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 11

হযরত মা ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনী বই - Part 11

নতুন বাড়িতে হযরত ফাতেমা

নবীয়ে দোজাহান হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বাসগৃহ হতে জামাতা হয়রত আলী (রাঃ)-এর ভাড়াটিয়া বাসগৃহটি ছিল একটু দূরে। প্রিয়নবী (সাঃ) আদরের দুলালী হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর খোজ খবর নিতে প্রায়ই যেতেন বলে তাঁর যাতায়াতে কষ্ট হত। প্রিয় নবী (সাঃ) নিজেই একদিন কন্যা ফাতেমাকে বললেন “মা” তোমাকে দেখতে আমার প্রায়ই আসতে হয় বিধায় আমার ইচ্ছা তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাই। 

প্রিয়নবী (সাঃ)-এর হৃদয়ের একান্ত কথা গুলো জেনে হযরত ফাতেমা (রাঃ) নিজেই বললেন আব্বাজান আপনার প্বার্শেই হারিসা (রাঃ) বিন নু’মানের অনেক বাড়ী রয়েছে। তাকে আপনি আমদের জন্য একটি বাড়ি খালি করে দিতে বলুন । প্রিয় নবী (সাঃ) কলিজার টুকরা হযরত ফাতিমার (রাঃ)-এর আবেদন মূলক কথা শুনে বললেন হে ফাতিমা। হারিসা বিন নু’মানের নিকট আমার বাড়ি চাওয়াকে আমি খুবই লজ্জাবোধ করি। 

লজ্জাবোধের অন্যতম কারণ হল যেহেতু সে প্রথমেই আল্লাহ ও তার রাসূলের রেজামন্দি হাসিলের জন্য কয়েকটি বাড়ী দিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তিত্বের অধিকারী লজ্জাশীলতা প্রতীক প্রিয় নবী (সাঃ)-এর কথা শুনে হযরত ফাতিমা (রাঃ) চুপ হয়ে গেলেন। 

যাই হোক প্রিয় নবী (সাঃ)-এর অনিচ্ছা স্বত্বেও ফাতেমা (রাঃ) আনহার আবেদন মূলক কথাগুলো হযরত হারিসা (রাঃ) বিন নু’মানের কানে গেল । যখনই তিনি জানতে পারলেন আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর কলিজার টুকরা নয়নের মনি ফাতিমাকে তার নিকটে আনার ইচ্ছা করে কিন্তু বাড়ী মিলতেছেনা । 

এহেন কথা শুনা মাত্রই তিনি নবীজীব (সাঃ) দরবারে উপস্থিত হলেন। হযরত হারিস (রাঃ) বিন নু'মান প্রিয়নবীর (সাঃ) দরাবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন হে নবী আপনি আপনার আদরের দুলালী হযরত ফাতেমা (রাঃ)-কে আপনার নিকটবর্তী কোন বাড়ীতে রাখার ইচ্ছা পোষণ করেন। তাসিদ্ধান্ত নিই হে নবী আমি আপনার সার্বিক সহযোগীতার জন্য সর্বদা প্রস্তুত আছি। 

আমি অতি সত্তরই আপনার বাস গৃহের নিকটবর্তী বাড়িটিই খালি করে দিচ্ছি। আপনি ফাতেমা (রাঃ) ডেকে পাঠান। আল্লাহর রাসূল হারিসার কথা শুনে বললেন তুমি যা শুনেছ তা অবশ্যই সত্য। আল্লাহ জাল্লাহ শানুহু তোমাকে বরকত ও কল্যাণ দান করুন । 

যাই হোক হযরত হারিসের কথা অনুযায়ী নবী দুলালী হযরত ফাতেমা (রাঃ) ও তার স্বামী হযরত আলী (রাঃ) হারিসার (রাঃ) প্রদত্ত বাড়িতে উঠলেন। নবী দুলালী হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় হযরত ফাতিমা (রাঃ) ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অনুসরণ যোগ্য মহিলা। 

কথা বার্তা, চাল-চলন, উঠা-বসা হাশি তামাসা সর্বক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন প্রিয় নবী (সঃ)-এর সর্বোত্তম উদাহরণ। ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ফাতেমার মধ্যে দ্বীনদারী পরহেজগার ও মুত্তাকির প্রভৃতির মহৎগুণ গুলি পাওয়া যেত। খোদা দ্রোহী কুরাইশ দের বয়কটের সময় শেয়াবে আবু তালিব বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি অনেক দুঃখ কষ্ট সুস্থ করেছিলেন যে দুঃখ কষ্টের কথা ইতিহাসের পাতায ও চির অঙ্কিত হয়ে রয়েছে।

এছাড়া মক্কা হতে মদীনায় হিজরতের সময় অনেক পথ ধরে হাটার কারনে ও তিনি খুবই কীনাঙ্গী হয়ে গিয়েছিলেন। সব চেয়ে আশ্চার্যের বিষয় হল অনেক কষ্ট করার পরও তিনি নিজ হাতে যাতা ঘুরিয়ে আটা তৈরি করতেন। অনেক সময় এমন ও দেখা গেছে যে যাতা ঘুরাতে ঘুরাতে তার হাত ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল। 

নবী দুলালী হযরত ফাতিমা (রাঃ) সাংসারিক সকল কাজই নিজে হাতে করতেন কিন্তু শত কষ্ট হলেও দুঃখ করতেন না বরং স্বামীকে নিজহাতে রান্না বান্না করে খাওয়ানো এবং কুপ হতে পানি উঠানোকে খুবই আনন্দের কাজ মনে করতেন তবে হযরত আলী (রাঃ) সাংসারিক অনেক কাজেই সময় সুযোগ পেলে ফাতিমা (রাঃ)-কে সাহায্য করতেন।

প্রিয় পাঠক পাঠিকা আমরা তো সকলে একথা জানি যে হযরত ফাতিমার স্বামী হযরত আলী নিতান্তই একজন গরীব মানুষ ছিলেন। যার কারণেই তিনি প্রিয়তমা স্ত্রী ফাতেমার সাংসারিক কাজে সাহায্য করার জন্য বাসায় কোন দাসী বাবদী রাখতে পারতেন না ।

হযরত আলী (রাঃ) এতই গরীব ছিল যে, অনেক সময়ই তাদের দিনের পর দিন, রাতের পর রাত না খেয়ে থাকতে হত। কোনএক দিনের ঘটনা একবার তাদের অবস্থা এমন হল যে ঘরে খাবার মত কিছুই ছিল না। 

স্বামী স্ত্রী উভয়ে প্রায় আট গ্রহর পর্যন্ত ভুখা কাটানোর পর হযরত আলী কোন একস্থানে কাজ করে মাত্র একদিরহাম কোন পেয়েছিলেন। কাজের বিনিময়ে এক দিরহাম নিয়ে যখন বাড়ি ফিরলেন তখন অনেক রাত। হাট বাজারের দোকান পাট সবই বন্ধ হয়ে গেছে তবুও অনেক খোজা খুজি করার পর এক দোকান হতে এক দিরহামের যব কিনে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরলেন। এদিকে অভুক্ত নবী ফাতিমা স্বামীর পথ চেয়ে পানে তাকিয়ে আছে। 

হঠাৎ স্বামীকে আসতে দেখে মনের মধ্যে আনন্দের ফোয়ারা জেগেছে। আর আনন্দে মেতে উঠার কথাও যেহেতু দিনের পর দিন না খেয়ে স্বামীর অপেক্ষায় আছেন। অভুক্ত ফাতিমা স্বামীকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন। স্বামী সাড়া দিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পরে বিশ্রাম নিচ্ছে এই ফাকে যবগুলো নিয়ে দ্রুত পিষলেন। রুটি তৈরি করে স্বামীকে খেতে দিলেন। স্বামী হযরত আলী (রাঃ)-এর খাওয়ার শেষ হওয়ার পর তিনি খেতে বসলেন। 

হযরত ফাতিমা (রাঃ) যখন আলী (রাঃ)-কে খাওয়ায়ে নিজে খেতেছেন এমনি সময় হযরত আলী আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বললেন প্রিয় নবী (সঃ) প্রায়ই বলতেন আমার কলিজার টুকরা হযরত ফাতেমা (রাঃ) হল রূপে গুণে আদর্শে উত্তম চরিত্রে দুনিয়ার সর্বোত্তম মহিলা। 

কোন এক বর্ণনা হতে জানা যায় প্রিয় নবী (সঃ)-এর জামাতা হযরত আলী (রাঃ) কোন এক আবেগ মুহুর্তে ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে বলেন, নবীজীর আদারের দুলালী হযরত ফাতেমার (রাঃ) ও তার স্বামী হযরত আলী (রাঃ)-এর অবস্থা আল্লাহর নবীকে অবহিত করাবেন এই বলে যে আপনার আদরের কন্যা মাতৃহারা ফাতিমার গরীব স্বামীর গৃহে চাক্কি (যাতা) চালাতে চালাতে হাতে দাগ পড়েছে, পানির কলসা টানতে টানতে কোমর কালসিটে হয়ে গেছে, ঘর বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে যেয়ে পরিধেয় কাপড় চোপড় সর্বদা ময়লা যুক্ত হয়ে থাকে। 

নবী দুলালী ফাতিমা (রাঃ) নিজেই বললেন রুটির জন্য আটার খামীর তৈরি করতে করতে আমার দু'হাতের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত বিক্ষত হয়ে আছে। এহেন দুঃখ কষ্টের মধ্যে তাদের সাংসারিক জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। 

এমনি মুহূর্তে শেরে খোদা হযরত আলী জানতে পারেন যে মুসলমানদের হাতে যুদ্ধে বন্দী বহু বাদী এসেছে। এ সংবাদ পাওয়া মাত্রাই মুচকি হাসি দিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী নবী দুলালী হযরত ফাতিমা (রাঃ)-কে বললেন তোমার সাংসারিক কাজে সাহায্য সহযোগীতা করার জন্য একজন দাসী নিয়ে এসো, আমার একান্ত বিশ্বাস তোমাকে যেভাবে আল্লাহর রাসূল ভালবাসে ও ভাল জানে এবং তোমার জন্য যে মায়া মমতা তাতে তুমি কোন দাসির জন্য আবেদন করামাত্রই তিনি দান করবেন। 

সত্যি স্বামী হযরত আলী (রাঃ)-এর বুদ্ধি ও কথা অনুযায়ী আল্লাহর রাসূল নবীর দরবারে উপস্থিত হলেন বটে অতিশয় লাজুক হযরত ফাতেমা (রাঃ) কিছুই বলতে সাহস পেলেন না। আল্লাহর নবী (সঃ) আদরের দুলালী হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর উপস্থিতি দেখে তার কারণ জিজ্ঞেস করলেন তখন ফাতিমা জবাবে বললেন আপনাকে সালাম দিতেই উপস্থিত হয়েছি।

দাসী না নিয়ে হযরত ফাতেমা (রাঃ) স্বামী গৃহে পৌছার সাথে সাথেই হযরত আলী (রাঃ) বুঝতে বাকি রইল না যে ফাতিমা (রাঃ) লজ্জার কারণেই প্রিয় নবীর দরবারে যেয়ে আসল সংবাদ গোপন রেখেছিলেন । যাই হোক হযরত আলী (রাঃ) নিজেই ফাতেমা (রাঃ)-কে নিয়ে নবীর দরবারে উপস্থিত হলেন । হযরত আলী (রাঃ) আদরের সাথে নম্রস্বরে প্রিয় নবী (সঃ)-কে বললেন হে নবী! আপনার আদরের কন্যা হযরত ফাতেমাতুজ জোহরা (রাঃ) লজ্জার কারণেই তার আসল কথা গোপন রেখেছিলেন। 

সে আপনার কাছেতার সাংসারিক কাজের সহযোগীতার জন্য গণীমতের একজন দাসী প্রার্থনা করেছে।
জামাতা হযরত আলী (রাঃ)-এর আবেদনের প্রেক্ষিতে নবী (সঃ) বললেন তোমাদের খেদমাতের জন্য আমি কোন কয়েদীকে দিতে পারি না । কেননা এখন আসহাবে ছফ্ফার খাওয়া পড়ার দায় দায়িত্ব আমাকেই করতে হবে।

আমি কেমন করে তাদেরকে ভুলে যাব যারা নিজেদের বাড়ি ঘরের মায়া মমতা ত্যাগ করে বিশ্ব জাহানের মালিক আল্লাহ তায়ালা ও তার প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর সন্তুষ্টির জন্য বুভুক্ষা ও দারিদ্রের পথ বেছে নিয়েছে।

একথা বলার পরই প্রিয় নবী কলিজার টুকরা হযরত ফাতিমা (রাঃ)-কে বললেন হে মা ফাতিমা। ধৈর্য ধর, সত্যিকার অর্থে সেই হল উত্তম মহিলা যার মাধ্যমে পরিবারে লোকজন উপকৃত হয়। প্রিয় নবী (সঃ)-এর প্রিয় কথাগুলো হৃদয়পটে অঙ্কিত করে স্বামী স্ত্রী একত্রেই তাদের বাসস্থানে ফিরলেন । 

রাত্রি বেলা প্রিয় নবী (সঃ) মেয়ের ঘরে উপস্থিত হলেন। তারা প্রিয় নবী (সঃ)-কে সালাম দিয়ে বসার স্থান করে দিলেন। তখন আল্লাহর হাবীব প্রিয় নবী (সঃ) বললেন আমার নিকটে তোমরা যা দাবী করেছিলে তার তুলনায় উত্তম বস্তু তোমরা রাজি আছ কি? 

তখন তারা আদবের সাথে নম্র কণ্ঠে বললেন হ্যা ইয়া রাসূলাল্লাহ । এর পরে তাদের দিকে তাকিয়ে প্রিয় নবী (সঃ) বললেন আমাকে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) নামাযের পর তিনটি বাক্য পাঠ করার জন্য বলেছেন সেই বাক্য তিনটি হলো তোমরা নামাযের পর ৩৩ বার সোবহানাল্লাহ ৩৩ আলহামাদুলিল্লাহ ও ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। রাতে বিছানায় যাওয়ার পূর্বে ও প্রতিদিন এ আমল করবে।

প্রিয় নবী (সঃ)-এর জামাতা হযরত আলী (রাঃ) বলেন যে দিন প্রিয় নবী আমাকে এই দোয়া পাঠ করার জন্য বলেছেন আমি সেই দিন হতেই আজ পর্যন্ত এই পবিত্র বাক্য সমূহ পাঠ করতে ভুলে যাইনি, হযরত আলী (রাঃ)-এর এহেন কথা শুনামাত্রই এক সাহাবী বললেন তাহলে কি আপনি সিফফিনের যুদ্ধের রাতেও এই দোয়া পাঠ করেছিলেন। সাহাবীর উত্তরে হযরত আলী (রাঃ) বললেন হ্যাঁ। আমি ঐতিহাসিক সিফফিনের যুদ্ধের রাত্রেও এই দোয়া পাঠ করেছিলাম ।